Logo
×

Follow Us

মতামত

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

Icon

শাহরীনা আখতার

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ২৩:৩৮

জলবায়ুর নতুন ছকে বদলে যাচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

মাটির মমতা আজ জলবায়ুর অনিশ্চয়তায় নড়বড়ে, তবুও আশার আলো দেখাচ্ছে বিজ্ঞান। বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ুর ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। ঋতু অনুযায়ী বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা এতদিন কৃষির ছন্দ তৈরি করলেও গত দুই দশকে সেই ছন্দপতন স্পষ্ট। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এই পরিবর্তন ক্ষীণ মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী, ফসলের সময় কমে গেছে, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের প্রকোপ বেড়েছে, সেচের চাহিদাও বেড়েছে।

বর্ষা আর আগের মতো ভরসাযোগ্য নয় : প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী, জুন-সেপ্টেম্বর ছিল নির্ধারিত বর্ষাকাল, কিন্তু এখন তা অনেক সময়েই বিলম্বিত বা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে। বৃষ্টির মোট পরিমাণ কমেনি, তবে এটি অল্প সময়ের মধ্যে অতিমাত্রায় বর্ষণের প্রবণতা দেখাচ্ছে। ২০২২ সালের জুনে সিলেটে মাত্র তিনদিনে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যা একটি বিপর্যয় হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে বিস্তীর্ণ হাওরের এলাকা ডুবে যায়, এবং নষ্ট হয়ে যায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বোরো ধান।

অন্যদিকে সাতক্ষীরা অঞ্চলে দেখা দেয় দীর্ঘ খরার ধকল, যার ফলে আমন চাষে দেরি হয়। এসব সমস্যার কারণে ফসলের উৎপাদনেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে, যা কৃষকদের জীবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

ফলনের মাঠে জয়-পরাজয়ের লড়াই : নিঃসন্দেহে, জলবায়ু পরিবর্তন কৃষি উৎপাদনে একের পর এক নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যেমন, একসময় যেই আমন ধান বর্ষার উপর নির্ভরশীল ছিল, তা এখন আর সেই নির্ভরতা বজায় রাখতে পারছে না। তেমনি, বোরো ধানও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের কারণে সেচের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ইতোমধ্যে ব্রি ধান ৫৬, ৭৫ ও ৯২ নামক জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে, যা আবহাওয়ার পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে কিছুটা হলেও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।

গমের উৎপাদন এখন ঠান্ডা অঞ্চলে স্থানান্তরিত হচ্ছে, কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এর ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)’র গবেষণার তথ্যমতে, মাত্র ২ক্কঈ তাপমাত্রা বৃদ্ধি হলে গমের উৎপাদন প্রায় ৩০% কমে যেতে পারে। গরমের প্রভাব টমেটো ও বেগুনের ওপরও পড়ছে, যা দ্রুত পেকে গেলেও মানের হ্রাস ঘটছে। তদুপরি, ডাল, সরিষা এবং সূর্যমুখীর মতো রবি ফসলও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। তবে ভুট্টা নিয়ে কিছুটা আশার খবর রয়েছে, এর তাপ সহনশীলতা ও বাজারে চাহিদার বৃদ্ধির ফলে এটি এখন কৃষকদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় রবি ফসল হয়ে উঠেছে। এ ধরনের উদ্ভাবন এবং চ্যালেঞ্জের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার কৌশলই কৃষির ভবিষ্যত রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

পাল্টে যাচ্ছে কৃষির মৌসুমি ছন্দ। এক সময়ের নির্ধারিত কৃষি ক্যালেন্ডার আজকাল অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ১০ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে, এই অঞ্চলে পানির অভাব এবং সেচের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একই সঙ্গে, এই অঞ্চলে নানা ধরনের নতুন রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে, যা

পূর্বে এ অঞ্চলে ছিল না। যেমন, রাইস ব্লাস্ট এবং ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার, এই ধরনের রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে, যা কৃষকদের জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের এই দুরবস্থা কৃষির পাশাপাশি আঞ্চলিক পরিবেশের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে, যা সামগ্রিকভাবে কৃষি ব্যবস্থাকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত : বিশ্বব্যাপী ২০২৩ সালে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ রেকর্ড পরিমাণ ৩৬.৮ বিলিয়ন টনে পৌঁছেছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের আরও গভীর সংকটের পূর্বাভাস দেয়। এই প্রবণতা বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও দুর্যোগের তীব্রতা বাড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি করছে। বাংলাদেশ, জার্মানওয়াচের জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে শীর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে, যা দেশের কৃষি ও মানবিক অবস্থা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতি আরও প্রকট হলে বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়বে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে।

অস্থিরতায় লাভ-ক্ষতির খেলা : ভুট্টা ও পাট কিছুটা লাভজনক হলেও, তা অত্যন্ত অনিশ্চিত। বারি’র তথ্য অনুযায়ী, সামান্য তাপমাত্রা ও ঈঙ₂ বৃদ্ধির ফলে কিছু অঞ্চলে ভুট্টার ফলন ১৫% পর্যন্ত বেড়েছে। তবে আবহাওয়ার অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এবং উৎপাদন খরচের বৃদ্ধির কারন এই লাভ স্থায়ী হচ্ছেনা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ঋঅঙ)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে উৎপাদন ব্যয় ১৮-২৫% বেড়েছে, যার ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকরা, যারা দেশের প্রায় ৮০%।

২০২৩ সালে হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় ৪৫০ কোটি টাকার ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৪ সালের বন্যায় ১১টি জেলায় ৫.৮ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ৩ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি ডুবে যায়।

এর ফলস্বরূপ, সরকারকে ৫ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এই ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি বাংলাদেশে কৃষির প্রতি ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, যা কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

বিজ্ঞান এগিয়ে আসছে কৃষকের পাশে : ব্রি ও বারি উদ্ভাবিত জলবায়ু সহনশীল জাত, এই সংকট কাটাতে সাহায্য করছে। ব্রি ধান ৯৬ এবং ৯২ লবণাক্ততা ও খরা সহনশীল, যা সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীতে চাষ হচ্ছে। ব্রি ধান ৯৬ লবণাক্ততা ৮ ফঝ/স পর্যন্ত সহ্য করে, এবং প্রতিকূলতায়ও ৪.৫৫ টন ফলন দেয়। বারি উদ্ভাবিত বারি গম-৩৩ (তাপ সহনশীল গম) ও বারি মুগ-৮ (মুগডাল) রাজশাহী ও দিনাজপুরে জনপ্রিয় হচ্ছে। বারি গম-৩৩-এর চাষ ২০২১ সালে ১৬ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ২৫ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে। এছাড়া কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কএঋ)-এর অর্থায়নে লবণাক্ততা সহনশীল সয়াবিন ও স্মার্ট ডালের মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা হচ্ছে নোয়াখালী ও বরিশালে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে সহায়তা করবে।

ডিজিটাল কৃষির হাত ধরে আশার আলো : অও, ওড়ঞ এবং মোবাইলভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে কৃষকদের তথ্যভিত্তিক সহায়তা প্রদান করছে এ-টু-আই (ধ২র)। ২০২৩ সালে, এসব প্ল্যাটফর্ম ১২ লাখ কৃষককে বাস্তবসম্মত আবহাওয়া তথ্য এবং পরামর্শ প্রদান করেছে, যার ফলে ফসলের ক্ষতি ২০% পর্যন্ত কমেছে। এই প্রযুক্তি কৃষকদের অনিশ্চয়তা হ্রাস করতে এবং সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং কৃষি খাতে উন্নতি সম্ভব হচ্ছে।

কৃষক-কেন্দ্রিক নীতিমালা জরুরি : ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ঘঅচ) থাকলেও বাস্তবায়নে গতি আনা জরুরি। জলবায়ু সহনশীল জাত, পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও ডিজিটাল সেবা বাড়াতে হবে। মোবাইলভিত্তিক আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং বৈচিত্র্যময় ও স্বল্পমেয়াদি জাতের চাষে উৎসাহ দেওয়া দরকার। সৌরচালিত সেচ ও ড্রিপ সেচে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ফসল বীমা চালু করা জরুরি।

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির সময় এখনই : জলবায়ু পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের সমস্যা নয়, এটি আমাদের বর্তমানের কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে এই সংকটের মধ্যে রয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। গবেষণা, বিনিয়োগ এবং কার্যকর শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে বিশ্বের সামনে একটি শক্তিশালী উদাহরণ স্থাপন করতে পারে। এখনই সময়, সাহসী ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

লেখক : টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট ও রিসার্চ অ্যাডভাইজার, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন 

Logo